জাকির নায়েকের মতো মুসলমানদের দাবী, বেদ-পুরানে, আল্লা-মুহাম্মদ এ্রর উল্লেখ আছে; কিন্তু বেদ-পুরানে, আল্লা-মুহাম্মদ,এই শব্দগুলো আসলে এলো কিভাবে ?
মূল প্রসঙ্গের একটু পেছন থেকে শুরু করি। মধ্যযুগের সব মুসলিম শাসকদের সভায় হিন্দু কবি ছিলো। ইসলামে যেহেতু কবিতা লিখা নিষেধ, তাই কোনো মুসলমানকে কবিতা লিখতে বলে বা তার কাব্য প্রতিভাকে বিকশিত করে, কোনো মুসলমান শাসক পাপের ভাগী হতে চাইতো না। এজন্য মুসলিম শাসকদের শাসন কার্যের কোথাও হিন্দুদের কোনো জায়গা না হলেও এবং তারা পাইকারিভাবে জোর জবরদস্তি করে সাধারণ গরীব হিন্দুদের মুসলমান বানালেও বা বানাতে চেষ্টা করলেও, জিজিয়া করের জন্য ধনী হিন্দুদের এবং কোনো কোনো মুসলিম শাসক ব্রাহ্মণ টাইপের জ্ঞানী হিন্দু পণ্ডিতদের হিন্দুত্ব টিকিয়ে রাখতো রাজসভায় কাব্য আলোচনা এবং তা থেকে রস আস্বাদনের জন্য। এভাবে যে সব হিন্দু, রাজসভায় কবি হিসেবে নিয়োগ পেতো, ধর্মের উপর জোর জবরদস্তি না করার জন্য তারা মুসলমান শাসকদের উপর থাকতো খুবই কৃতজ্ঞ এবং অনুগত। এই কবিদেরকে, তাদের পৃষ্ঠপোষক মুসলমান শাসকের ফরমায়েশ এবং পছন্দ অনুযায়ী কবিতা লিখতে হতো। এই পছন্দকে পাত্তা দিতে গিয়ে এবং মুসলমান শাসকদেরকে খুশি করতে গিয়েই হিন্দু কবিরা তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হিন্দু ধর্মের মূল গ্রন্থগুলো সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করার সময় বিকৃত করেছে। কারণ, ঐ কবিদের পৃষ্ঠপোষক, মুসলমান শাসকদের খুশির উপরই নির্ভর ছিলো ঐ সব দুর্বল বেতন ভোগী হিন্দু কবিদের জীবন জীবিকা। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, বাংলা সাহিত্যের যত হিন্দু ধর্মীয় পুস্তক, সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই করা হয়েছে, মধ্যযুগের এই মুসলিম শাসনের সময়।
উদাহরণ স্বরূপ, কৃত্তিবাসী রামায়ণের ব্যাপারে একটু আলোচনা করছি; সংস্কৃত রামায়ণে, সীতাকে যখন রাবন ধরে নিয়ে যায়; তখন সীতা, রাবনের সাথে ভয়ংকরভাবে সাহসের সাথে তর্ক বিতর্ক করে। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে ঐ সময়ে সীতা একজন ভীরু ও দুর্বল মহিলা। কৃত্তিবাসী রামায়নে রামের চরিত্রও দুর্বল করে দেখানো হয়েছে এবং তাকে নপুংসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কেননা, কৃত্তিবাসী রামায়ণে, রামের চরিত্র নিয়ে এই প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে, রাম-সীতা বনে ১২ বছর এক সাথে থাকার পরেও কেনো সীতা গর্ভবতী হলো না ? কিন্তু সংস্কৃত রামায়ণের এই তথ্যকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে যে, বনবাসে যাওয়ার আগেই রাম সীতা প্রতিজ্ঞা করেছিলো, বনে গিয়ে তারা কোনো ভোগ-বিলাসে মত্ত হবে না; তারা বনবাসকালীন ব্রহ্মচর্য পালন করবে। তো যারা ব্রহ্মচর্য পালন করবে, তাদের সন্তান হবে কিভাবে ? এইভাবে মুসলিম আমলে অনুবাদিত প্রত্যেকটি গ্রন্থ, সেটা ভারতের যে আঞ্চলিক ভাষাতেই হোক, তাকে কিছু না কিছু বিকৃত করা হয়েছেই।
রামায়ণ সম্পর্কে আরও একটা তথ্য এ প্রসঙ্গে আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি, বলা হয় রামের জন্মের ৬ হাজার বা ৬০ হাজার বছর পূর্বে বাল্মীকি মুনি রামায়ণ রচনা করেন। এটা একটা ডাহা মিথ্য অপপ্রচার। বাল্মীকি মুনি, রামের সমসাময়িক এবং লংকার যুদ্ধ শেষে রাম অযোধ্যায় ফিরে আসার পর রামায়ণ লেখা শুরু হয়। এটা আমার মত নয়, হিন্দু ধর্মের বই পুস্তক নিয়ে যিনি বহু গবেষণা করেছেন এবং "হিন্দু ধর্ম, ভদ্রলোকের ধর্ম" এই পরম সত্য যার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, সেই ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, রামায়ণ রচনার সময় নিয়ে উপরের ঐ মত ব্যক্ত করেছেন।
যা হোক, ইংরেজরা, মুসলমানদের মতো সরাসরি হিন্দুদের জীবন ও ধর্মে আঘাত না করলেও, হিন্দু সংস্কৃতিকে সুকৌশলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা হিসেবে খ্রিষ্টান সমাজের অনুরূপ ক’রে রাজা রাম মোহন রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদু প্রিন্স দ্বারাকানাথের মাধ্যমে বা্রহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে। ব্র্রাহ্মদের আচার আচরণ খ্রিষ্টানদের মতো হওয়ায়, সেই সময়ের নিষ্ঠাবান হিন্দুরা ব্রাহ্মদেরকে খ্রিষ্টানই মনে করতো। এই ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের পরামর্শে ইংরেজরা বেদকে বিকৃত করার পরিকল্পনা করে। ইতোমধ্যে বাংলায় তারা ছাপাখানা স্থাপন করে ফেলেছিলো এবং সেখান থেকে প্রথম মুদ্রিত বই রূপে বাইবেল প্রকাশ করেছিলো। এরপর তারা বেদ প্রিন্ট করে। সেই সময় অথর্ববেদের শেষের দিকে অপ্রাসঙ্গিকভাবেকয়েকটি দুর্বল শ্লোক যুক্ত করে এবং তার মধ্যে আল্লাহ, মুহম্মদ এরকম কয়েকটি ইসলামিক শব্দটি ঢুকিয়ে দেয়; যেগুলোর মাধ্যমে জাকির নায়েক প্রমান করার চেষ্টা করে যে বেদ এ মুহম্মদের কথা বলা আছে এবং মুহম্মদই কল্কি অবতার, সুতরাং জাকির এর মতে হিন্দুদের উচিত, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যাওয়া। এছাড়াও অনেকে জানেন যে, ভবিষ্য পুরান লেখা হয়েছিলো সম্রাট আকবরের সময়ে এবং তাতেও ইসলামের এই সব বিষয় ঢুকানো আছে, যা দ্বারা জাকির হিন্দুদেরকে বিভ্রান্ত করছে, আর মূল বিষয় না জেনে হিন্দুরাও আমাদের ধর্মগুরুদের উদাসীনতায় বিভ্রান্ত হচ্ছে।
এই বিভ্রান্তি এড়াতে, হিন্দু ধর্মের মুল বিষয়গুলো জানতে হলে পড়তে হবে সংস্কৃত গ্রন্থগুলো এবং তাও যথেষ্ট সতর্ক হয়ে- কারণ, ইংরেজ আমলে প্রথম প্রিন্ট হওয়া সংস্কৃত গ্রন্থগুলো হানড্রেড পার্সেন্ট অবিকৃত নয়।
যখন কোনো পুস্তকে বাইরে থেকে কিছু ঢোকানো হয়, তখন তাকে তাকে বলে প্রক্ষেপণ বা প্রক্ষিপ্ত। তো বেদ এর মধ্যে মুহম্মদ, আল্লা শব্দ যুক্ত শ্লোকগুলো যে প্রক্ষিপ্ত তা কিভাবে বুঝবেন ?
কোরানের মতো বেদ একটি জগাখিচুড়ি গ্রন্থ নয়। একই বিষয়ে বিভিন্ন কথা বার্তা কোরানের বিভিন্ন আয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আবার একই রকম কথাও আছে বিভিন্ন আয়াতে। কিন্তু চারটি বেদের বিষয় বস্তু চার রকম এবং একই বেদ এ একই রকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূত্রে চারটি বেদ এর শেষ সংকলন অথর্ববেদ এর বিষয়বস্তু হচ্ছে মারণ, উচটান, বশীকরণে ব্যবহৃত তন্ত্র -মন্ত্র। তো সেই তন্ত্র মন্ত্রের মধ্যে মুহম্মদ, আল্লা এই শব্দযুক্ত শ্লোকগুলো আসবে কোথা থেকে, যদি সেগুলোকে পরে ঢোকানো না হয় ? জাকিরের মতো মুসলমানরা, অথর্ববেদ ছাড়াও হিন্দু ধর্মের যে সব গ্রন্থের মধ্যে ইসলামকে খুজেঁ পায়, সেগুলো হলো ভবিষ্যপুরান এবং আল্যাউপনিষদ।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি ভবিষ্যপুরান সম্রাট আকবরের সময়ে লেখা, এবং আল্যাউপনিষদও সেই সময়েই লেখা। কারণ, হিন্দু শাস্ত্রে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে যে উপনিষদ ১২ টি, এই ১২ টি উপনিষদের মধ্যে আল্যাউপনিষদ বলে কোনো কিছু নেই। আর পুরানগুলোর মধ্যেও ভবিষ্যপুরাণ বলে কিছু নেই। এই পোস্টের শেষে উপনিষদ ও পুরানের একটি লিস্ট দিয়েছি, সেখানে গিয়ে দেখে নেবেন সেগুলোর মধ্যে মুসলমান কর্তৃক আবিষ্কৃত ভবিষ্যপুরান ও আল্যাউপনিষদ বলে কিছু আছে কিনা ? পুরান শব্দটি হিন্দুদের মাঝে অনেক প্রচলিত বলে ভবিষ্য শব্দের সাথে পুরান শব্দটি যুক্ত করে সাধারণ হিন্দুদেরকে ধোকা দেওয়ার একটি চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।
ReplyDeleteএই ভাবে নতুন উপনিষদ, পুরান লিখে সম্রাট আকবরের সময় থেকে এবং অথর্ববেদ এর মধ্যে নতুন শ্লোক ঢুকিয়ে ইংরেজ আমলে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলে আসছে । সুতরাং জাকির এবং তার অনুসারীদের হিন্দু সমাজ ধর্ংসের যে চেষ্টা, সেটা নতুন কিছু নয়, সেটা পুরোনো চেষ্টারই নতুন রূপ মাত্র।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম। জয় শ্রী কৃষ্ণ।
জেনে নিন উপনিষদ ও পুরানগুলোর নাম :
১২ টি উপনিষদ – (১) ঈশ, (২) কেন, (৩) কঠ, (৪) প্রশ্ন, (৫) মুন্ডক, (৬) মান্ডুক্য, (৭) তৈত্তিরীয়, (৮) ঐতরেয়, (৯) শ্বেতাশ্বতর, (১০) ছান্দোগ্য, (১১) বৃহদারণ্যক, (১২) কৌষিতকী।
এই ১২ টি উপনিষদের ১০৮ টি উপউপনিষদ রয়েছে, এগুলো ১২ টিরই বিভিন্ন ভাগ উপবিভাগ।
ভালো করে দেখুন তো এগুলোর মধ্যে আল্যাউপনষিদ বলে কিছু আছে কিনা।
এবার আসি পুরানে। পুরান ২ প্রকার : মহাপুরান ও উপপুরান। মহাপুরান ৬ টি
উপপুরান ১৮ টি।
৬ টি মহাপুরানের নাম – (১) বিষ্ণুপুরাণ, (২)পদ্মপুরাণ, (৩)বায়ুপুরাণ, (৪)স্কন্দপুরাণ,(৫)মার্কন্ডেয়পুরাণ এবং (৬)ভাগবত পুরাণ । কল্কি পুরান, বিষ্ণু পুরানেরই একটি অংশ।
ভালো করে দেখুন তো এগুলোর মধ্যে ভবিষ্যপুরান বলে কিছু আছে কিনা।
ভাগবতপুরাণ আবার দুই ভাগে ভাগ বিভক্ত-
(১) দেবী ভাগবত (শ্রীদুর্গার শক্তি ও মাহাত্ম্য বর্ণিত) এবং
(২)শ্রীমদ্ভাগবতবা বিষ্ণু ভাগবত (শ্রীকৃষ্ণের শক্তি ও মাহাত্ম্য বর্ণিত)।
১৮ টি উপপুরাণের নাম- (১) আদি (২) নৃসিংহ, (৩) বায়ু, (৪)শিবধর্ম (লিঙ্গপুরান) , (৫) দুর্বাসঃ, (৬) বৃহন্নারদীয়, (৭) নন্দিকেশ্বর, (৮) উশনঃ, (৯) কপিল, (১০) বরুণ, (১১) শাম্ব (১২) কালিকা, (১৩) মহেশ্বর, (১৪) দেবী, (১৫) ভার্গব, (১৬) বশিষ্ট (১৭) পরাশর এবং (১৮) সূর্য।
আবার ও ভালো করে দেখুন তো এগুলোর মধ্যে ভবিষ্যপুরান বলে কিছু আছে কিনা।
ReplyDeleteএছাড়াও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান সহ আরও কিছু পুরানের নাম আপনারা শুনে থাকতে পারেন, যেগুলোর রচয়িতা হিসেবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু আসলে এগুলো পুরানের বিশাল তালিকার মধ্যে এক একটি প্রক্ষিপ্ত পুরান, যেগুলো মুসলিম শাসনামলে রচিত এবং যেগুলোর উদ্দেশ্যই ছিলো হিন্দু ধর্মকে ধ্বংস করা।
মুসলমানদের প্রশ্নের জবাব আপনি দিতে পারেন না, এর অর্থ হলো আপনি হিন্দু ধর্ম এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না। এটা আপনার ঘাটতি, কিন্তু হিন্দু ধর্মে কোনো ঘাটতি নেই।
আবারও বলছি
জয় শ্রীরাম।
From Uttam Kumar DAS'S TIMELINE.