আইএসের বিস্তার ও পশ্চিমবঙ্গ - এক মহা সঙ্কটের সিঁদুরে মেঘঃ
সারা বিশ্বের ধর্মান্ধ উগ্র সুন্নি জঙ্গিদের কাছে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এখন একটা ভয়ংকর ক্রেজ। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জন্ম নেওয়া বাহারি আরবি নামের জঙ্গি সংগঠনগুলো সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের অনুসারী বা শাখা সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার জন্য উন্মাদের মতো লম্ফঝম্প করছে। নিজেদের সক্ষমতা জাহির করে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ ও স্বীকৃতি আদায় করাই এখন সুন্নিজঙ্গি সংগঠনগুলোর মুখ্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে; যার সর্বশেষ উদাহরণ কুয়েতের শিয়া মসজিদে, তিউনিসিয়ার পর্যটনকেন্দ্রে এবং ফ্রান্সের একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণ। বিধমী হত্যা, সভ্যতার নিদর্শনে ধ্বংসযজ্ঞ, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং বর্বর কর্মকাণ্ডের এদের মূল কাজ । কৌশল ও কর্ম পদ্ধতি নিয়ে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস ও আল-কায়েদা আপাতত এখন ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও উভয়ের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আল-কায়েদার শাখা আল নুসরা ফ্রন্ট থেকে আলাদা হয়ে সৃষ্টি হয় সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। সারা বিশ্বের সুন্নি অঞ্চল নিয়ে একজন সুন্নি খলিফার অধীনে একটি সুন্নি খেলাফত সৃষ্টি করাই তাদের লক্ষ্য। মানবসৃষ্ট আইনের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা মোতাবেক সুন্নি কোরআন, সুন্নাহ ও সুন্নি শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত হবে সেই খেলাফত সুন্নি রাষ্ট্র। সব সুন্নি মুসলমানকে এটা মেনে নিতে হবে, প্রশ্ন করা যাবে না। যারা মানবে না তাদের বিধর্মী বা কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হবে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনীতি ও সামরিক এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক বাস্তবতায় এটা যে একটা অলীক স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছু নয়, সেটি উপলব্ধি করার মতো সক্ষমতা এদের নেই। শিয়া সম্প্রদায়ের শাসক সিরিয়ার আসাদ, ইরাকের শিয়া কর্তৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ও আরব বিশ্বের সব শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের প্রধান টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করেছে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাক দখলের পর চাকরিচ্যুত সাদ্দাম হোসেন সুন্নি সরকারের সুন্নি সম্প্রদায়গত বিরাটসংখ্যক প্রশিক্ষত, দক্ষ ও নিবেদিত সেনা সদস্যরা সংগত কারণেই সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ইরাক শিয়া সরকারের বর্তমান সেনাবাহিনীর টপ টু বটম আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ায় যুদ্ধ করার মতো মনোবল ও মানসিকতা কোনোটাই তাদের নেই। এসব কারণে ২০১৪ সালের ২৯ জুন সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর স্বল্প সময়ের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল তারা দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্র এবং ইরাকি সরকারি বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ভাণ্ডার সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের দখলে এসেছে। যুদ্ধ চালানোর মূলশক্তি টাকা ও অস্ত্র তারা প্রথম ধাক্কায়ই পেয়ে গেছে। বিশ্বের কোথাও তাদের কোনো জবাবদিহি না থাকার কারণে তারা যা ইচ্ছা সে রকম ভয়ংকর আচরণ করতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্রের অফিশিয়াল ভাষ্য মতে, গত এক বছরে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে তিন হাজার বিমান আক্রমণ চালানো হয়েছে। তাতে নিহত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার সুন্নিপন্থী জঙ্গি। আইএসের বিস্তার ও পশ্চিমবঙ্গ সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস তাদের সক্রিয় অপারেশন ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারছে এবং তাদের বর্বরতার মাত্রাও সব সীমা অতিক্রম করছে। গত বছর এবং এ বছরেও খোদ সৌদি আরবেও শিয়া মসজিদে আক্রমণ চালিয়ে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিসর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে আইএস, আল-কায়েদার শাখা সংগঠনগুলো এখন পূর্ণ মাত্রায় সক্রিয় আছে। এসব দেশে তাদের প্রধান টার্গেট শিয়া সম্প্রদায়। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম ও সোমালিয়ার আল শাবাব দুই সুন্নি সংগঠনই এরই মধ্যে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছে এবং আবু বকর বাগদাদিকে তাদের খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় তো প্রতিনিয়তই শিয়া হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। উপরন্তু পাশের দেশ নাইজার, চাদ ও ক্যামেরুনে প্রায়ই সন্ত্রাসী অপারেশন করছে। অন্যদিকে সোমালিয়াভিত্তিকআল শাবাব পার্শ্ববর্তী কেনিয়া, তানজানিয়া ও ইথিওপিয়ায় সন্ত্রাসী অভিযানের বিস্তৃতি ঘটিয়ে সুদানকে ব্যবহার করছে আল শাবাব ও বোকো হারামের সংযোগ স্থল হিসেবে। মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ডে এখন চলছে সুন্নি জিহাদি কর্মকাণ্ড। কিন্তু যতই ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালাক না কেন, বিশ্বের কোনো দেশেই তারা সরাসরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনবরত মানুষের রক্তক্ষরণ ও বর্বরতার এত বড় ওজন বহন করা মানবসভ্যতার জন্য এখন প্রচণ্ড ভারী হয়ে উঠছে। ইরাক ও সিরিয়ায় ভূখণ্ডগত অবস্থান, অস্ত্র-গোলাবারুদের শক্তি, সম্পদের ব্যাকআপ এবং ধর্মীয় উন্মাদনার শক্তি এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে ২০০১ সালে আফগানিস্তান বা ২০০৩ সালের ইরাক অভিযানের মতো বড় আকারের সর্বাত্মক সামরিক অভিযান ছাড়া সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করা এখন আর সম্ভব নয়। সে রকম ঘটলে তাতে হয়তো আইএস পরাজিত হবে ও বিশ্বব্যাপী অন্যান্য দেশের সুন্নি জিহাদিদের উন্মাদনা কমবে। কিন্তু তাতে মানবিক সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে কি না বা ইরাক তো শেষই, তার সঙ্গে সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে আরো ধ্বংসযজ্ঞ বৃদ্ধি পাবে কি না, এসব নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ভিন্নমত আছে। কারণ ইরাক ও আফগানিস্তানের উদাহরণ কারো জন্য স্বস্তিদায়ক হয়নি। অনেকের ধারণা, চলমান গৃহযুদ্ধের একপর্যায়ে সিরিয়ার আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হবেন এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে আইএস। তখন আফগানিস্তানে তালেবান শাসন হটানোর কায়দায় যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব, জর্দান একত্র হয়ে বড় আকারের সামরিক অভিযান চালিয়ে সিরিয়া দখল করে নেবে।
তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটা সহজ হবে, তা অনেকাংশ নির্ভর করবে আঞ্চলিক শক্তি ইরানের ওপর। সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এখন বিশ্ব মানবসভ্যতা ও গণতন্ত্রের জন্য একরকম উভয় সংকটের সৃষ্টি করেছে। এর শেষ কোথায়, তার সহজ উত্তর কেউ দিতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ তাঁর সামরিক কমান্ডাররা বলছেন, এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই, এর সমাধান এখন একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়।
ReplyDeleteআরব বিশ্বের শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের ফলে উদ্ভূত সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস উন্মাদনা এখন পশ্চিমবঙ্গের মতো শান্তিকামী গণতান্ত্রিক রাজ্যকেও ভোগান্তিতে ফেলছে। প্রায়ই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গি সংগঠনগুলো সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস বা আল-কায়েদা উন্মাদনায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টা চালাচ্ছে; গোয়ন্দাদের দেওয়া তথ্য মতে, এই গ্রুপ যে তিনটি লক্ষ্য সাধনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজ্যব্যাপী বোমা হামলা চালিয়ে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। উদ্দেশ্য একই, নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়ে সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসর স্বীকৃতি আদায় করা। সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী যেসব সদস্য বিগত কয়েক মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্নিপন্থী জঙ্গি গ্রুপের সদস্যরা কিছুদিন পরপরই বিপুল পরিমাণ বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদিসহ গ্রেপ্তার হচ্ছে। এতে দুটি বিষয় প্রমাণিত হয়। প্রথমত, দায়িত্বরত গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদা জাগ্রত, প্রস্তুতি পর্বে সবাই ধরা পড়ছে। দ্বিতীয়ত, প্রমাণিত হয় সুন্নিপন্থী জঙ্গিরা বসে নেই, তারা অনবরত প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বলা হয়, ভারতে সুন্নি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত বিরাট জনসংখ্যার রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সুন্নিপন্থী জঙ্গিদের টার্গেটের তালিকায় প্রথম দিকে আছে। ইয়াকুবের ফাঁসির আদেশ ঘোষণা হওয়ার পর সুন্নি মুসলিম-শিবির রাজ্যব্যাপী ভয়ানক তাণ্ডব চালায়।কতগুলো বাস্তবতার জন্য বিশ্ব অঙ্গন থেকে আইএস ও আল-কায়েদা নির্মূল বা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গেকে পরিপূর্ণভাবে মুসলিম জঙ্গিমুক্ত রাখা কঠিন। ইসলামীয় আদর্শের নামে মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো কাজ করে ৯ কোটি ১০ লক্ষ জন-অধ্যুষিত রাজ্য, যার প্রায় ২০-২৫ শতাংশ সুন্নি মুসলিম ( ১০% শিয়া), সেখানে বিশ্বের মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো আশ্রয় খুঁজবে, সেটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া চরম মুসলিম তোষন , রাজনৈতিক বিভাজন, সেই বিভাজনের এক পক্ষের ভেতরে সব উগ্রবাদী ধর্মীয় দলের অবস্থান, বিশালসংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্র আধুনিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি উপাদান মুসলিম জঙ্গি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলোর সফলভাবে মোকাবিলার বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি। তাই বিগত পাঁচ-সাত বছর গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুসলিম জঙ্গি দমনে যেভাবে সফলতা দেখিয়েছে, সেটিকে আরো শক্তিশালী ও প্রসারিত করতে হবে, যদি আমরা মোটামুটি আশঙ্কামুক্ত থাকতে চাই।