কালাপাহাড় ছিলেন বাংলা বিহারের শাসনকর্তা সুলায়মান খান কররানী র এক দুর্ধর্ষ
সেনাপতি; তার আসল নাম রাজীবলোচন রায় মতান্তরে কালাচাদ রায়। ডাকনাম রাজু।বাড়ি
ছিল রাজশাহী র বীরজাওন গ্রামে। তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন; তার পিতার
নাম ছিল নঞানচাদ রায়(ইনি গৌড় বাদশাহের ফৌজদার ছিলেন)। তিনি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান
ছিলেন ।নিয়মিত বিষ্ণু পূজা করতেন। সুলায়মান খান কররানী যখন গৌড়ের শাসক
সেসময় তিনি গৌড়ের সেনানীতে যোগদান করেন এবং অতি অল্পকালের
মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সুনজরে পতিত হন। ইতোমধ্যে
সুলায়মান খান কররানী র কন্যা দুলারি বিবি তাঁর প্রণয়ে পড়লে শর্ত সাপেক্ষে ইসলাম
ধর্ম অনুসারে সুলেমান কন্যার পাণিগ্রহণ করেন এবং সুলায়মানের প্রধান সেনাপতির
পদ অলংকৃত করেন । কিন্তু ইসলাম কন্যা বিবাহের সুবাদে হিন্দুধর্ম তাকে ঘৃণা ভরে
প্রত্যাখ্যান করে। আর সেই কারণে প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম
গ্রহন করে 'মহম্মদ ফর্ম্মুলি' নাম ধারণ করেন এবং প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে
ওঠেন।আর তখন থেকেই কালাপাহাড় নামে পরিচিত হন।১৫৬৮ সালে তিনি পুরীর
জগন্নাথ দেবের মন্দির আক্রমণ করেন এবং মন্দির ও বিগ্রহের প্রচুর ক্ষতিসাধন
করেন ।[১] [২]
কালাপাহাড়ের সমরাভিযান
১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে উড়িষ্যার রাজা
হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম বন্দর
অধিকার করে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের
সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন সেই অবসরে সুলায়মান খান কররানী
উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে
সুলায়মান কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্যসংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ
করতে সৈন্য পাঠান। এইসময় মুকুন্দদেব তাঁরই এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে
নিহত হন; এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটরায় উড়িষ্যার সিংহাসন
দখল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত
হয়েছিলেন। [৩]
কোচরাজ নরনারায়ণ, সুলায়মান খান কররানীর রাজত্বকালে গৌড়রাজ্য আক্রমণ
করেছিলেন কিন্তু কালাপাহাড় একাধারে রাজা নরনারায়ণের ভাই এবং সেনাপতি
শুক্লধ্বজকে পরাজিত করে আসামের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে
নিয়েছিলেন। এইসময়ে কামাখ্যা ও হাজোর প্রাচীন মন্দিরগুলিতে কালাপাহাড়
নির্বিচারে ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিলেন।[৪] মোগল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে
কালাপাহাড় আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গদেশ ও বিহারে আকবরের
বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় কালাপাহাড় তাতে যোগদান করেন এবং অনুমান করা হয়
তিনি এই যুদ্ধে নিহত হন (এপ্রিল ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) ।
মন্দির ধ্বংসকারী কালাপাহাড়
মুসলিম কন্যা বিবাহের কারণে কালাপাহাড় সমাজচ্যুত হন। মায়ের অনুরোধে কিছুদিন
পর তিনি বাংলার ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তেরবিধান চাইলে তারা কোন বিধান
দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে
প্রায়শ্চিত্তেরসংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাকে ও তার স্ত্রীকে
মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং তার কোন প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে
জানিয়ে দেন। এতে কালাপাহাড় মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে
পড়েন। তাই উড়িষ্যা অভিযানকালে তিনি উড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানের উপর
প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পান। ১৫৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দ দেবের
বিরুদ্ধে সুলাইমান কররাণীর পুত্র বায়েজিদ খান কাররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার
উজবেকের যুদ্ধে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালাপাহাড় উড়িষ্যা ও তার
নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। পুরীর
জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা
যায়, কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলীর
তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন। [৫]
কালাপাহাড় উড়িষ্যার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে
কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর , ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দিরে
ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। কালাপাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব
ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘন্টা মন্দিরের
ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই
অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমাদের হাতগুলো খসে পড়ত। এতে উপস্থিত
লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। কালাপাহাড় মন্দির
সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মন্দির
আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালাপাহাড় সম্বলপুরের মা সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে
আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে
উপস্থিত হন। সম্বলেশ্বরী মন্দিরের পূজারীরা মন্দির রক্ষার্থে এক দুঃসাহসী
পদক্ষেপ নেন। একজন নারীকে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালাপাহাড়ের
ছাউনিতে পাঠানো হয়। তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিষ মিশ্রিত দুধ, দই, ছানা, বিক্রি করেন।
পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালাপাহাড়ের বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা
গেলে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যান।[৬]
কালাপাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের ঘটনা ঊড়িষ্যা ও মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
কাররাণীদের কুচবিহার আক্রমণকালে কালাপাহাড় আসামের কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো
কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালাপাহাড় কররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান কররাণীর
আমল পর্যন্ত কররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে
অভিযানগুলোতে অংশগ্রহন করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীদের পতনের
পর কালাপাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং
মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল
সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই
যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন। [৭]
'
No comments:
Post a Comment