Friday, 4 December 2015

প্রায় সব সময়ই শুনি যে, মুসলমানরা নাকি সারা পৃথিবীতে খুবই নির্যাতিত।

প্রায় সব সময়ই শুনি যে, মুসলমানরা নাকি সারা পৃথিবীতে খুবই নির্যাতিত। শুনে খুব খারাপ লাগে, আহারে বেচারা মুসলমানরা। সবাই মিলে মিশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কত শত্রুতাই না করছে। কত ষড়যন্ত্রই না করছে। ছোটবেলা ওয়াজ মাহফিলে হুজুরেরা ওয়াজ করতো, কেঁদে কেটে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাত, হে আল্লাহ, মুসলমানদের তুমি এই সব জালিমের হাত থেকে রক্ষা করো। শুনে ভাবতাম, কারা এই সব জালিম, যারা মুসলমানদের শত শত বছর ধরে নির্যাতন করে যাচ্ছে? একবার সামনে পেলে একদম দেখিয়ে দিতাম! কিন্তু তাদের দেখতে পেতাম না। চারপাশে সব দিকেই মুসলমান দেখতাম। কারণ বাঙলাদেশ তো মুসলমানদেরই দেশ। এই দেশে কারা ঠিক মুসলমানদের অত্যাচার করছে ঠিক বুঝতাম না। হিন্দুরা? বৌদ্ধরা? নাকি খ্রিস্টান বা ইহুদীরা? নাকি ভুত? ছোটবেলা শুনতাম ইউরোপে নাকি মুসলমানদের ওপর অনেক অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়। তারপরেও নাকি ইউরোপে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। প্রতিদিন হাজার হাজার অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে চলে আসার খবর পেতাম, আমাদের এলাকার হুজুর, মসজিদের বড় ভাইয়েরা সেগুলো বেশ গর্ব করেই বলতো। কিন্তু সেখানে মুসলমানদের ওপর সীমাহীন নির্যাতনের খবর পেতাম। আমেরিকা আর ইসরাইলে নাকি রাস্তায় মুসলমানদের ধরে ধরে হত্যা করা হতো। কথাগুলো এলাকার যেই বড় ভাই বলতো, ডিভি লটারি সে কিন্তু প্রতিবছরই পূরণ করতো। একবারও মিস হয় নি। শেষমেশ অন্য আরেকজনার ডিভি লটারি টাকা দিয়ে কিনে সে আমেরিকা চলে গেল। এখন শুনেছি বউ বাচ্চা নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতেই আছে। কিন্তু মুসলমানদের ওপর যেখানে এত অত্যাচার হয়, সেই দেশে সে কেন গেল আজও বুঝলাম না। তার তো সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। যেখানে মুসলমানরা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। সে যাইহোক। ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের গল্প শুনে। বড় হওয়ার পরে তাই এই পর্যন্ত দেশে দেশে মুসলমানদের ওপর কী পরিমাণ নির্যাতন হয়েছে তা যাচাই করতে বসে গেলাম। অদ্ভুত তথ্য পেলাম। কয়েকটা উদাহরণ দেই। যেমন ধরুন, ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করে। যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। যারা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল তারাও মুসলমানই। আবার ধরুন, মাওলানা মওদুদীর নির্দেশে এবং উস্কানিতে পাকিস্তানে প্রায় ১০ লক্ষ আহমদিয়াকে হত্যা করা হয়। তারা মুসলমানই ছিল। এবারে আরও কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। পরিসংখ্যানগুলো গণহত্যার অল্পবিস্তর পরিসংখ্যান। সাদ্দাম হোসেন- ৬ লক্ষ (১৯৭০-২০০৩ ) সুহার্ত- ৫ লক্ষ ( ১৯৬৫-৬৬, ১৯৬৯-বর্তমান) মোল্লা ওমর/ তালিবান- ৪ লক্ষ (১৯৮৬ - ২০০১) হাসান তারাবি - ১ লক্ষ (১৯৮৯ - ১৯৯৯) ইরাক ইরান যুদ্ধ - ১০ লক্ষ (১৯৮০-১৯৮৮) কুয়েত যুদ্ধ - ১.৪০ লক্ষ (১৯৯০-১৯৯১) আলজেরিয়া - ৭ লক্ষ ( ১৯৫৪-১৯৬২) আলজেরিয়া - ২ লক্ষ (১৯৯১ - বর্তমান) সোমালিয়া - ৪ লক্ষ (১৯৯১- বর্তমান) নাইজেরিয়া - ১১ লক্ষ (১৯৯৩ - বর্তমান) লেবানন - ১.৫ লক্ষ ( ১৯৭৫ - বর্তমান) ইথোওপিয়া - ১৫ লক্ষ ( ১৯৭৫ -১৯৭৯) সিয়েরালিয়ন - ২ লক্ষ (১৯৯১ - বর্তমান) আই এস - বাশার - ২.২ লক্ষ ( ২০১১ - চলছে) এগুলো ছাড়া পাকিস্তানে রোজ বাচ্চাদের স্কুলে বোমা হামলা, এবং মুসলমানদের হাতে খ্রিস্টান ইহুদী বৌদ্ধ হিন্দুদের মৃত্যুর আরেকটি বড় পরিসংখ্যান দেয়া যেতে পারে। সেগুলো না হয় বাদী দিচ্ছি। উপরের সবগুলো যুদ্ধেই কোন না কোন ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, চীন ইত্যাদি দেশগুলো জড়িত ছিল। ঠিক যেমনটা ছিল বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও। কিন্তু বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইসলামপন্থীরা ভারত রাশিয়ার চক্রান্ত বলে চালাবার যত চেষ্টাই করুক না কেন, পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান দুই ভাইয়ের মধ্যে গণ্ডগোল লাগিয়ে দেয়ার কথা যতই বলুক না কেন, সত্যি হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের অপশাসনে অতিষ্ট হয়েই বাঙলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল। সব সময় বলতে শুনি, সবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ভারত ইসরাইল ইত্যাদির চক্রান্ত। কিন্তু অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের অস্ত্র বিক্রি করবে সব জায়গায়, সেটাই স্বাভাবিক। তারা দুই পক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করবে। কিন্তু যদি বলা হয়, দুই পাকিস্তান একসাথে সুখে শান্তিতে ছিল, ভারত মাঝখান দিয়ে ঢুকে চক্রান্ত করে দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়েছে, তা হবে ডাহা মিথ্যা কথা। যখন এই পশ্চিমা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করা হয়, তখন সব চাইতে বড় সত্য, পশ্চিম পাকিস্তানের গণহত্যা এবং তাদের অত্যাচারকে কৌশলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাই করা হয়। যারা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করে, তারা আসলে অসৎ উদ্দেশ্যেই করে। এসব নিহতদের প্রায় সকলেই মুসলমান। এছাড়া কোটি কোটি মুসলমান আহত হয়েছে, গৃহহীন উদ্বাস্তু হয়েছে, নারী এবং শিশুরা হয়েছে ধর্ষিত, লাঞ্ছিত। তাদের আর কোন ভবিষ্যৎ নেই, কোন আশা নেই। অনেকেই ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন, সুন্দর জীবনের আশায়। এই সকল হত্যাকান্ড,অপকর্ম কিন্তু মুসলমান মুসলমানদের সাথে করেছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৪৮ সালের পর থেকে প্রায় দেড়কোটি মুসলমানদের হত্যা করা হয়, যার প্রায় ৮৫ ভাগই করেছে কোন না কোন মুসলিম শাসক, বা অন্য মুসলমানরা। শিয়ারা সুন্নিদের মেরেছে, সুন্নিরা শিয়াদের মেরেছে। আবার দুই পক্ষ মিলে মিশে আহমদিয়াদের মেরেছে। এ ওকে মেরেছে সে তাকে মেরেছে। এভাবেই চলে যাচ্ছে। বাঙলাদেশের মত দেশে প্রতি মাসেই হিন্দু বৌদ্ধ আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের কথা না হয় বাদই দিলাম, পাকিস্তানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার কথাও না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু মুসলমানদেরই আসলে কারা হত্যা করছে? কারা নির্যাতন করছে? মামদো ভুত? ইহুদীরা? হিন্দুরা? খ্রিস্টানরা? ইউরোপ আমেরিকা? ইসরাইল? নাকি খোদ আল্লাহ? Written by: Asif Mohiuddin

No comments:

Post a Comment