“বহুত্বের মধ্যে একত্বই প্রকৃতির ব্যবস্থা, হিন্দুগণ
এই রহস্য ধরিতে পারিয়াছেন। অন্যান্য ধর্ম
কতকগুলি নির্দিষ্ট মতবাদ বিধিবদ্ধ করিয়া
সমগ্র সমাজকে বলপূর্বক সেগুলি মানাইবার চেষ্টা
করে। সমাজের সন্মুখে তাহারা একমাপের জামা
রাখিয়া দেয়; জ্যাক, জন, হেনরি প্রভৃতি সকলকেই
ঐ এক মাপের জামা পরিতে হইবে। যদি জন বা
হেনরির গায়ে না লাগে, তবে তাহাকে জামা না
পরিয়া খালি গায়েই থাকিতে হইবে। হিন্দুগণ
আবিষ্কার করিয়াছেনঃ আপেক্ষিককে আশ্রয়
করিয়াই নিরপেক্ষ পরম তত্ত্ব চিন্তা উপলব্ধি
বা প্রকাশ করা সম্ভব; এবং প্রতিমা ক্রুশ বা
চন্দ্রকলা প্রতীকমাত্র, আধ্যাত্মিক ভাব প্রকাশ
করিবার অবলম্বনস্বরূপ। এই প্রকার সাহায্য যে
সকলের পক্ষেই আবশ্যক তাহা নয়, তবে অধিকাংশ
লোকের পক্ষেই এই প্রকার সাহায্য আবশ্যক। যাহাদের
পক্ষে ইহা আবশ্যক নয়, তাহাদের বলিবার
কিছুমাত্র অধিকার নাই যে, ইহা অন্যায়। আর
একটি বিষয় বলা আমার অবশ্য কর্তব্য।
ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা বলিলে ভয়াবহ একটা কিছু
বুঝায় না। ইহা দুষ্কর্মের প্রসূতি নয়, বরং ইহা
অপরিণত মন কর্তৃক উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাব ধারণা
করিবার চেষ্টাস্বরূপ। হিন্দুদেরও অনেক দোষ আছে,
অনেক বৈশিষ্ট্যও আছে; কিন্তু লক্ষ্য করিও,
তাহারা সর্বাবস্থায় নিজেদের দেহপীড়নই করে,
প্রতিবেশীর অনিষ্ট করে না। কোন ধর্মোন্মাদ
হিন্দু-চিতায় স্বীয় দেহ দগ্ধ করিলেও ধর্মগত
অপরাধের প্রতিবিধান করিবার জন্য কখনও
অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে না; ইহাকে যদি তাহার
দুর্বলতা বলো, সে দোষ তাহার ধর্মের নয়, যেমন
ডাইনী পোড়ানোর দোষ খ্রীষ্টধর্মের উপর দেওয়া
যায় না।
অতএব হিন্দুর পক্ষে সমগ্র ধর্মজগৎ
নানারুচিবিশিষ্টনরনারীর নানা অবস্থা ও
পরিবেশের মধ্য দিয়া সেই এক লক্ষ্যের দিকে
অগ্রসর হওয়া ব্যতীত আর কিছু নয়। প্রত্যেক ধর্মই
জড়ভাবাপন্ন মানুষের চৈতন্য-স্বরূপ- দেবত্ব
বিকশিত করে, এবং সেই এক চৈতন্য-স্বরূপ ঈশ্বরই
সকল ধর্মের প্রেরণাদাতা। তবে এত পরস্পরবিরোধী
ভাব কেন? হিন্দু বলেন- আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন
ভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের
উপযোগী হইবার জন্য এক সত্যই এরূপ পরস্পর-
বিরুদ্ধ ভাব ধারণ করে। একই আলোক ভিন্ন ভিন্ন
বর্ণের কাচের মধ্য দিয়া আসিতেছে। সকলের
উপযোগী হইবে বলিয়া এই সামান্য বিভিন্নতা
প্রয়োজন। কিন্তু সব কিছুরই অন্তস্তলে সেই এক
সত্য বিরাজমান। শ্রীকৃষ্ণাবতারেভগবান্
বলিয়াছেন : সূত্র যেমন মণিগণের মধ্যে, আমিও
সেইরূপ সকল ধর্মের মধ্যে অনুস্যূত। যাহা কিছু
অতিশয় পবিত্র ও প্রভাবশালী, মানবজাতির
উন্নতিকারক ও পাবনকারী, জানিবে-সেখানে
আমি আছি।” - স্বামী বিবেকানন্দ
------------------------------------------- হিন্দুধর্ম
প্রসঙ্গ থেকে
No comments:
Post a Comment