Wednesday, 9 December 2015

তালাক তালাক তালাক...

লেখাটি দীর্ঘ পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো ........ তালাক তালাক তালাক... - তালাক পাপ। অন্যায়। উচিৎ নয়। এমন নীতি মুলক শব্দের খেলায় মুসলিম মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়.... ?? .... তীব্র প্রশ্ন আফরোজা খাতুনের। (গত ২৯/১১/২০১৫ তারিখের “আজকাল রবিবাসরের” একটি যুগোপযোগী ও অত্যন্ত মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনঃ) সম্প্রতি অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড জানিয়ে দিয়েছে, একই সঙ্গে তিনবার তালাক বলা অপরাধ কিন্তু যদি বলেই ফেলে তাহলে বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়। তার মানে অপরাধকে মান্যতা দিচ্ছে মুসলিম ল’ বোর্ড। ২০০৪ সালে তিন তালাকের সমাধান খুঁজতে আদর্শ নিকাহনামা তৈরির কথা ভেবেছিল মুসলিম ল’ বোর্ড। তখন বোর্ডের ঘোষণা ছিল, নিকাহের চুক্তিতে আর্থিক দায়ভার যেহেতু পুরুষকেই নিতে হয় তাই তালাকের অধিকার তাদের হাতেই থাকা উচিত। এই অধিকার মেয়েদের দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই। এই নিকাহনামায় লেখা হয় ‘তিন তালাক আসলে পাপ। যে কোন ধর্মবিশ্বাসী মুসলিমদের উচিত এই পাপ থেকে বিরত হওয়া।’ অর্থাৎ তিন তালাককে বাতিল না করে তাকে পাপ আখ্যা দিয়েই দায়মুক্ত হচ্ছেন ল’বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা।আর আদর্শ শরিয়তি মুসলিম স্বামীদের তা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। যাঁরা আদর্শ স্বামী নন তাদেঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত তা কিন্তু ল’বোর্ড জানান নি। পাপ, অন্যায়, উচিত নয় এমন নীতিমূলক শব্দের খেলায় মুসলিম মেয়েদের কতটুকু নিরাপত্তা রয়েছে প্রশ্ন সেখানেই। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মেয়েদের অবস্থানের নিরিখে আলোচনায় এগোলেই গ্রাহ্যহীন হয়ে যায় তিন তালাকের সাম্প্রতিক ফতোয়ার মান্যতা। বেশিরভাগ তালাক হয় ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য। বিয়ের পর হঠাৎ মনে হল বৌকে তত সুন্দরী মনে হচ্ছে না, অথবা পণের সামগ্রী শোধ করতে পারছে না, এরকম নানা কারণ তৈরি হলে মুসলিম পুরুষের খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। হাতে অস্ত্র রয়েছে। যে কোন অজুহাত দেখিয়ে তিন তালাকের গলাধাক্কায় মুহুর্তে দাম্পত্য ভেঙে দিতে পারেন। এর জন্য কাউকে কৈফিয়ৎ দেওয়া জরুরি নয়। সে ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশ প্রশাসন যেই হোক না কেন। ভারতের মুসলিম পুরুষ এখনও মৌখিক তালাক দিতে পারার অধিকার নিয়ে জন্মায়। আর মুসলিম মহিলারা সেই তালাকে বিপন্ন হওয়ার দায়িত্ব বহন করে। এটা শুধু সম্ভাবনার কথা বলছি না। এমনটাই ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে সন্ধানী দৃষ্টি দিলেই উঠে আসবে এই সত্য। রেহেনা খাতুনকে চিনতাম ছোটবেলা থেকেই। বিয়ে হয়ে চলে আসেন উত্তর চব্বিশ পরগণায়। দীর্ঘ তিরিশ বছর পর দেখা হল তাঁর সঙ্গে। ছেলে-মেয়েরা ছোট থাকাকালীন তালাক দিয়েছেন স্বামী। তাঁর স্বামী মেয়েকে বেশি পড়াশোনা করাতে চাইছিলেন না। রেহেনা জোর করেছিলেন পড়ানোর জন্য। স্ত্রীর এই মত প্রকাশের স্পর্ধাকে কাবু করতেই তালাকের আঘাতে বিবাহ বিচ্ছেদ। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ও বৌ রেহেনা কাপড় ভর্তি ভারি ব্যাগ কোমরে নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে কষ্টার্জিত উপার্জনে ছেলে-মেয়ে দুটিকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেন। স্বামী দ্বিতীয় সংসার নিয়ে মসগুল। এমন তালাককে আজও টিকিয়ে রাখার ফতোয়া দিচ্ছে ল’বোর্ড! গ্রাম-গঞ্জের বাস্তবরূপকে উপেক্ষা করে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের এই দাপটকে কিন্তু রেহেনারা আর মেনে নিতে রাজি নন। তালাকের বিরোধিতায় নেমে মহিলাদের সংগঠিত করছেন তিনি। সাউথ কলকাতা সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন-এর এ বছরের বার্ষিক আলোচনাসভায় এসে জানিয়ে গেছেন মৌখিক তালাককে বন্ধ করতে হবে সরকারি হস্তক্ষেপে। এর জন্য আন্দোলন দরকার। এবং সে আন্দোলনের সক্রিয় শরিক হওয়ার শপথ নিয়েছেন রেহেনা। কারণ নিজের জীবন দিয়ে যে বুঝেছেন এই শব্দের ব্যবহার বিধির ধংসাত্মক প্রক্রিয়াকে। নদিয়ার সবজি বিক্রেতা আলতাফ ছোটাছুটি করলেন প্রশাসনের কাছে। তাঁর আর্থিক সঙ্গতি নেই বাচ্চাসমেত মেয়ের জীবনধারণের অর্থ যোগান দেওয়ার। জামাই আর একটা বিয়ে করবে। মেয়ে মেনে নিতে চাইছিল না তাই জামাই মেয়ের ওপর অত্যাচার চালাত। আলতাফ মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন থানায় অভিযোগ জানাবেন বলে। জামাই বুঝতে পেরে মেয়েকে তালাক দিয়ে দেয়। ডোমেস্টিক ভায়লেন্স অ্যাক্ট-এ নালিশ করার আর জায়গা থাকে না আলতাফের মেয়ের। প্রশাসনের সাহায্য চাইতে গিয়ে জানতে পারেন মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে দেখা মেলে তালাক হয়ে যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে। কত বিচিত্র কারণে ব্যবহার হয় তালাক। সাবিনা, জ্যোৎস্না, সারভানুদের তালাকের কারণ ও তালাক দেওয়ার ধরণ বিচিত্র। পণ দিতে না পারার জন্য সাবিনাকে নিয়মিত মারত শ্বশুর বাড়ির লোকেরা। সাবিনা স্বামীর লাঠির হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে একদিন পালিয়ে যায়। এমন অবাধ্য স্ত্রী যে কিনা স্বামীর লাঠিপেটা খেতে অগ্রাহ্য করে। তাই মুসলিম পুরুষের হুংকারে নির্ধারিত হয়ে যায় তালাক। বাচ্চা নিয়ে জ্যোৎস্না বাবার বাড়ি বেড়াতে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই পিয়নের হাতে চলে আসে তালাকনামা। জ্যোৎস্না জানেন না কেন তাঁকে তালাক দি্লেন। সারভানু, আকলিমা, নাজিরা, রাবিয়াদের তালাকেরও ন্যায্য অন্যায্য বিচার হয় নি। বাংলার গ্রামে গ্রামে বৌ জব্দের তালিকায় তালাকের রমরমা। স্বার্থান্ধ মুসলিম পুরুষের মোক্ষম অস্ত্র তালাক। শরিয়তের নামে এমন জব্বর ক্ষমতা ভোগ করার লালসা কী মুসলিম পিতৃতন্ত্র ছাড়তে পারে? এদেশে মুসলিম রক্ষণশীলদের ধর্ম রক্ষার জন্য নাকি কান্নার বহর দেখা যায় কেবল মৌখিক তালাক ও বহুবিবাহ জীইয়ে রাখতে চেয়ে এবং উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের অসম বন্টন ব্যবস্থা বহাল রাখতে চেয়ে। তাই ভারতীয় মুসলিমরা দুটি আইনে বাস করে। দেশের আইন এবং মুসলিম ব্যক্তিগত আইন। ফৌজদারি আইন সব ভারতবাসীর জন্য এক। মুসলিমরাও সেখানে একই বিচার পায়। কিন্তু দেওয়ানি আইনে মুসলিমরা আলাদা। সেখানে মৌখিক আইন যা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের নামে চলে। নীতির ফড়ফড়ানি আর আদর্শের কচকচানিতে আইন অটুট রাখা যায় না। আদর্শ মুসলিম পুরুষরা অজুহাত দেখিয়ে তালাক দেন না ঠিকই কিন্তু যাঁরা দিচ্ছেন তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিও তুলছেন না। গ্রামে গ্রামে নিম্ন আয় ও নিম্ন অবস্থানের মুসলিম মেয়েরা শোষিত, নির্যাতিত, অসম্মানিত হচ্ছে তালাকের দাপটে।

4 comments:

  1. সন্তুষ্টজনক পণ না পেয়ে যে মুসলিম পুরুষটি তালাক দেয়, অন্যায় আচরণ ধর্মের জন্য তাকে কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। মসজিদে ঢোকার পথ কেউ আটকায় না। সমাজ একঘরে করে না। প্রশাসন শাস্তি দেয় না। এই মুসলিম পুরুষরা বিনা বাধায় হাসতে হাসতে আবার কোনও মেয়েকে বলি করার পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু পণ দিতে পারিনি বলে কেন তালাক দিলে বা পণ নেওয়া মুসলিম ধর্মে হারাম, তাই এ তালাক মানব না বললে সেই মেয়েকে একঘরে হতে হয়। সাবিনা পেয়েছিলেন সেই হুমকি। তালাক মেনেছিলেন বাধ্য হয়ে। তারপর আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বারোবছর চলেছিল তাঁর লড়াই। যে দেশে মুসলিমদের বিবাহ-বিচ্ছেদেরজন্য লিপিবদ্ধ আইন নেই, সেখানে আদালতের দ্বারে অর্থ দণ্ড আর সময় নষ্ট হবে তেমনটাই বাস্তব। সাবিনা সেই বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন ‘হয় কথায়, নয় কথায় তালাক আর মানব না। তালাক হবে আদালতের মাধ্যমে। আমাদের জীবনের কথা বলতে যতদূর যেতে হয় যাব। জানিয়ে দেব দুর্বিষহ অত্যাচারের কথা। সরকারকে আইন করতেই হবে। নইলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’ একই গ্রামে বাস করা সাবিনার স্বামী সাবিনাকে তালাক দেওয়ার পর পরই আরও দুটো বিয়ে করেছেন। বলিষ্ঠ পদক্ষেপে চলেছে তাঁর ইচ্ছেখুশি জীবণধারণের প্রক্রিয়া। আটকানোর কোনও আইন নেই যে তাই।
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একটি গ্রাম্য পটচিত্র’ গল্পের দিলারা সাক্ষী বহন করছে বাস্তবের দিলারাদের জীবনের। দিলারার স্বামী ইরফানের অল্প আয় ছিল টেলারিং-এর ব্যবসা থেকে। হটাৎ লটারীর টাকায় বড়লোক হয় ইরফান। তারপরই সাতাশ বছরের দাম্পত্য জীবন ক্লান্তিকর ঠেকে। নতুন বড়লোক ইরফান বোঝে দিলারাকে তাড়িয়ে অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে সুখের পূর্ণতা প্রাপ্তি হবে। তাড়ানোর পথ অতি সুগম। কাজের চাপে ইরফানের চাওয়া বেলের সরবৎ তার মুখের সামনে দিলারা হাজির করতে পারেনি বলে চারজন সাক্ষীর সামনে ইরফান ঘোষণা করে, এ বাড়িতে দিলারার আর ঠাঁই নেই। ইরফান তালাক দেয় দিলারাকে। ‘রাগের মাথায় কাজটা করে ফেলেছে বটে, কিন্তু তুমি হাসতে হাসতে বললে না চোখ পাকিয়ে চিৎকার করে বললে, শরিয়ত তো তা দেখতে যাবে না। ধর্মের বিধান মানতেই হবে।’ সাতাশ বছর ধরে গড়ে তোলা নিজের সংসারে দিলারার ঠাঁই নেই, এই কথাটা প্রথমে তাঁর অবিশ্বাস্য ঠেকে। সে ফুঁসে উঠতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। ‘তালাক শব্দ তিনবার এবার তার মর্মে আঘাত দিল। নিজের মায়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তার যা অবস্থা হয়েছিল, থরথর করে কেঁপে উঠেছিল শরীর, সেই রকম ভাবেই থুপ করে বসে পড়ল মাটিতে, উলটে গেল চক্ষু দুটি।’ বিনা বাধায় ইরফান আবার বিয়ে করল তার চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট লায়লাকে।
    সাহিত্যের সমাজ-বাস্তবতায় ধরা পড়ছে মৌখিক তালাকের নির্মম চিত্র। আরসাদ ও কুলসমের মধ্যে গণ্ডগোলের সূত্রপাত নাতির ডাক্তার দেখানো নিয়ে। সমাধান তালাকে এসে। মহাশ্বেতা দেবীর ‘তালাক’ গল্পের ষাট বছরের আরসাদ তার পঞ্চাশ বছরের স্ত্রী কুলসমকে তর্কে কাবু করতে না পেরে তালাক বলে ফেলে। বিবাহ-বিচ্ছেদেরএই সরলীকরণই বিপদ ডেকে আনে তাদের জীবনে।
    নীহারুল ইসলামের ‘জৈবন কেচ্ছা’ গল্পের জৈবনের তালাক হয় স্বামীর খুশিকে প্রশ্রয় দিতে গিয়েই। ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেই জৈবনের স্বামী আফসার আলি বুঝতে পারে শরিয়ত বিরোধী কাজ হয়েছে। তাই মৌলবিদের ডেকে এনে জৈবনকে জানান দেয় দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙনের কথা। এই তালাকের কারণ ব্যাখ্যা করে মৌলবি- ‘আপনার স্বামীর কথায় গতরাত্রের ঘটনার পর আপনারা আর স্বামী-স্ত্রী নন। শরিয়তে এমনই বিধান আছে যে, সহবাসকালে স্ত্রীর বুকের দুধ স্বামীর মুখে গেলে তারা আর স্বামী-স্ত্রী থাকে না’। জৈবনবিবি জানত না শরিয়তের এমন নির্দেশ। ‘তাছাড়া স্বামীর ইচ্ছায় সে তো বাধা দিতে পারে না। এটাও তো শরিয়তের কথা।’ তালাকের নির্মমতা নিয়ে বাস্তবের নিদর্শন সাহিত্যে উঠে আসছে আজও।
    ধর্মের নামে মুসলিম মেয়েদের ওপর অত্যাচার চলছে এবং চলবেও, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের ফতোয়া থেকে এমনটাই আঁচ করা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে ব্যক্তি মানুষের ওপর অবিচার হলে তার বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই নীতি মুসলিম মেয়েদের জন্য খাটছে না। এদেশের মুসলিম মেয়েদের সমস্যাকে ব্যক্তি মানুষের সমস্যা ( বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকার সম্পত্তির বন্টনের ক্ষেত্রে।) হিসেবে ধরা হয় না। সে চিহ্নিত হয় সম্প্রদায় হিসেবে।
    মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড কী ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের অভিভাবক? মেয়েদের অধিকারের জায়গা তাঁরাই নির্দিষ্ট করবেন? আর মেয়েদের অধিকার পাওয়ার প্রসঙ্গেই বুঝি শরিয়তের শুদ্ধতা নষ্ট নয়? ভারতীয় মুসলিম জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ক্রমাগত ধর্মীয় নির্দেশের বৃত্ত ভাঙছেন। জীবনের ধর্ম, যুগের ধর্মের দাবিতে তাই পরিবর্তন আসছে। মুসলিম ধর্মের নির্দেশে ছবি তোলা হারাম (নিষিদ্ধ)। ভারতের প্রতিটি মুসলিম ছবি তুলছেন ভোটার পরিচয়পত্র তৈরির জন্য। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী থেকে অফিস যাত্রী প্রত্যেকের পরিচয়পত্রে ছবি লাগছে।

    ReplyDelete
  2. ইসলাম ধর্মে সুদ নেওয়া এবং সুদ দেওয়া দুটোই নিষিদ্ধ। অথচ কম-বেশি সকল মুসলিম ব্যাংকে টাকা রাখেন, জীবনবিমা করেন। গৃহঋণ নেন। ব্যাংক, জীবনবিমায় সুদ নিচ্ছেন। গৃহঋণ শোধ করার সময় সুদ দিচ্ছেন। শুরু হয়েছে বিয়ে রেজিস্ট্রিকরণ। মুসলিম সম্প্রদায় মেনে নিয়েছেন এ আইন। হোক না তা মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার দিয়ে রেজিস্ট্রি। কিন্তু এটা বুঝেছেন রেজিস্ট্রি না করলে পরিচয়পত্রে সমস্যা হবে। ভবিষ্যতে সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাই শুধু মৌলবি দিয়ে মৌখিকভাবে বিয়ে পড়ানো আর চলছে না। জীবন বাস্তবতা তাহলে অনেক পরিবর্তন আনছে। তৈরি হচ্ছে নতুন আইন। বিয়ে যখন আর মৌখিক নয় তবে বিচ্ছেদ কেন মৌখিক থাকবে?
    শরিয়তের আইনকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সময়োপযোগী করে নেওয়ার নজির ভূরি ভূরি। এদেশেই নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মরক্কো, তিউনেশিয়া, ইয়েমেন, তুরস্ক, মালদ্বীপ, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, আলজেরিয়া বিভিন্ন দেশেও পরিবর্তন এসেছে জীবনের দাবিকে স্বীকার করে। এইসব দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের তালাক ও বহুবিবাহের ক্ষেত্রে যুগের সমস্যার নিরিখে আইনের পরিবর্তন হয়েছে। শুধু ব্যতিক্রমী নজির রেখে চলেছে ভারতবর্ষ। এদেশে মুসলিম মেয়েদের নির্যাতনের পথটিকে জিইয়ে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস চলছে এখনও। দেশের নানা প্রান্তে তালাক জর্জরিত মেয়েদের কান্না কান পেতে শোনেন না তাঁরা। ইসলামের প্রথম যুগে আরবের নব্য প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ফতোয়া ছিল একটি গঠনমূলক প্রতিষ্ঠানের ভুমিকায়। কিন্তু আজ এই শব্দটি নিপীড়নের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফতোয়া যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের হাতে ধর্ম একটি অশুভ নির্যাতনের হাতিয়ার।
    বহু আলোচিত হয়েও সাম্প্রতিক ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অতীত ফতোয়ায় নিগৃহীত কিছু মুসলিম মহিলার প্রসঙ্গ আলোচনায় আনতে হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে গোটা দেশে ঝড় তুলেছিল শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়। ইন্দোরের আইনজীবী মহম্মদ আহমেদ খাঁ তাঁর স্ত্রী শাহবানুকে তালাক দেন। এই তালাকের বিরুদ্ধে খোরপোশের মামলা করে সুপ্রিম কোর্টে শাহবানু জেতেন। কিন্তু সেদিন রক্ষণশীলরা হৈ হৈ করে ওঠে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলে। তার ফল হিসেবে রাজীব সরকারের নির্দেশে মুসলিম মহিলা বিল পাস হয়। এই বিল অনুযায়ী তালাক দিলেও মুসলিম মহিলারা খোরপোশ দাবি করতে পারবে না। শরিয়তের নামে স্বার্থপরতাকে প্রতিষ্ঠিত করল রক্ষণশীল মুসলিম পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে জোটবাঁধা রাজনীতি। শ্বশুরের দ্বারা মুজফুফর নগরের ইমরানা ধর্ষিত হওয়ায় ভারতের শরিয়তি মুফতি রায় দিয়েছিল, ইমরানা তালাক হয়ে গিয়েছেন। তিনি আর স্বামী নুর ইলাহির সঙ্গে থাকতে পারবেন না। কারণ ইমরানার পাঁচ সন্তানের সঙ্গে স্বামী নুর ইলাহিও নাকি আর একটি সন্তানের মতো হয়ে গিয়েছিলেন শ্বশুর ধর্ষণ করায়। মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডও একই যুক্তিতে বহাল রাখে ফতোয়া। মুসলিম সমাজের অনমনীয় পর্বতপ্রমাণ শরিয়তি আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ইমরানার হয়নি। বাধ্য হয়ে মেনেছেন তালাক। শরিয়ত ঘেঁটে ইমরানার পবিত্র অপবিত্রতার প্রসঙ্গ উঠেছে। শরিয়তি আইনের বিচার শিরোধার্য্ করিয়ে ছেড়েছে। কিন্তু ইমরানার শ্বশুরের বিচার কী শরিয়ত আইনে হয়েছে? ক্রিমিন্যালদের জন্য তো রয়েছে দেশের আইন। নির্যাতিতা ইমরানার বিচার হল শরিয়ত আইনে আর ধর্ষক শ্বশুর গেলেন দেশের আইনে। অদ্ভুত এ দ্বিচারিতা। শরিয়ত আইন অনুযায়ী অঙ্গ ছেদ হওয়ার কথা। তখন কোথায় গেলেন শরিয়তপন্থীরা? ফতোয়ার রকমভেদ নিয়ে উঠে আসে আরও প্রশ্ন। ইমরানার এই তালাককে ন্যায্য বলে মেনে নেননি মুর্শিদাবাদের কিছু মৌলবি। তাঁরা প্রতিবাদে সেদিন পথে নেমেছিলেন। তাহলে ফতোয়ার গায়ের জোরের ওপর নির্ভর করে তার বাস্তবায়ন। কোন তালাক গ্রাহ্য হবে আর কোনটা হবে না তা এলাকা অনুযায়ী বিচার্য্য তাহলে? তার সঙ্গে অর্থের সম্পর্কও বুঝি অস্বীকার করা যায় না। গল্পকার বদরুজ্জামান চৌধুরীর ‘লাখ টাকার মানুষ’ গল্পে রয়েছে ফতোয়া বিক্রির কাহিনী। বশীর তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। বশীরের মা এবং ভাই কাদির এই তালাক মেনে নিতে পারে না। বশীরের স্ত্রীও তালাক চাই না। কাদির তার মা, এবং ভাবিকে নিয়ে এলাকার বিয়ে ও তালাক সম্পর্কিত ব্যাপারের ভারপ্রাপ্ত কাজি নঈমুদ্দিনের কাছে যায়। সব শুনে কাজি জিজ্ঞেস করেন,-‘আগে বলো এখন কী ঠিক করছো, তোমার ভাবিরে তোমার ভাইর ঘরো রাখবা না বিদায় দিবা? রাখলে এক কথা বিদায় দিলে আরেক কথা। ...তয় খরচ একটু বেশি লাগবো।’।
    ভারতের মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ ভোটার। রাজনৈতিক নেতাদের হাতের সংখ্যালঘু তাস। মুসলিম রক্ষণশীলদের তোল্লাই না দিলে ভোটের রাজনীতিতে চলা যে বড় দায়। স্বাধীন ভারতবর্ষে হিন্দু মেয়েদের বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বন্ধ, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার এবং ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পৈত্রিক সম্পত্তির সমানাধিকারের দাবিতে হিন্দু কোড বিল আসে পার্লামেন্টে। সেই সময় হিন্দু সমাজে গেল গেল রব ওঠে। দেশের তাবড় তাবড় নামজাদা লোকেরাও বিলের বিরোধিতা করেন। প্রবল চাপের মুখেও হিন্দু কোড বিল পাস হয়ে যায়। পাকিস্তানেও ১৯৬১ সালে আয়ুব খানের সময় মুসলিম পারিবারিক আইন পাস হয়।

    ReplyDelete
  3. আইন এখন বাংলাদেশেও চালু। সেখানে মৌখিক তালাকের কোনও মূল্য নেই। তালাক উচ্চারণ করার পর চেয়ারম্যানকে ( ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র/প্রশাসক ইত্যাদি) লিখিত নোটিস দিতে হয়। সালিসি পরিষদ চেষ্টা করে বিচ্ছেদ আটকানোর। সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে নোটিস পাঠানোর তারিখ থেকে নব্বই দিন অতিক্রান্ত হলে তালাক কার্যকর হয়।
    ঘটনার নজির প্রমাণ দেয় রক্ষণশীলতা নয় এ হল সংখ্যালঘু বিপন্নতা। স্বাধীনোত্তর ভারত ও পাকিস্তান সরকার নিজের নিজের দেশের সংখ্যাগুরুদের আইনের সংস্কারে মনোযোগী হয়েছে। উদাসীনতা থেকে গেছে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে। তাই বাংলাদশের হিন্দু মেয়েরা যেভাবে রক্ষণশীল হিন্দু জনসমাজ ও রাষ্ট্রীয় নীতির পেষণে আজও ক্ষতিগ্রস্ত, ভারতের মুসলিম মেয়েরাও তেমনটাই ক্ষতিগ্রস্ত। ভারত-বাংলাদেশেরসংখ্যালঘুদের আইন সংস্কারের প্রশ্নে ভোট বড় বালাই হয়ে দেখা দেয়। কোন রাজনৈতিক দল ধর্মীয় নেতাদের কোপে পড়তে চায় না। ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও ধর্মে ইন্ধন জুগিয়ে চলে। রাজনৈতিক দলগুলিরও আকর্ষণ মুসলিমদের ইমাম, মুফতি, মৌলবি, মাদ্রাসা আর ইফতারের আসরের দিকে। মুসলিম মেয়েরা তো এদেরই অনুসারী। তাদের জীবনের দিকে তাকিয়ে লাভ তো নেই নেতাদের। ভোট পেতে হলে তোয়াজ তো করতেই হবে। তাতে কিছু মুসলিম মেয়ের জীবন গেল আর এলো। ধর্মে প্রলেপ বুলিয়ে ভোট তো আদায় হল। ধর্মনীতি আর রাজনীতির আঁতাতে ভারতের মুসলিম মেয়েরা ফতোয়ার গিলোটিনে চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু বর্তমান ভারত সাক্ষর বহন করতে চলেছে আর এক দৃশ্যের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাঝে মাঝেই আওয়াজ উঠছে, মুসলিমদের জন্য মৌখিক আইন আর নয়। সেই ঝাঁকুনি খেয়েই মুসলিম ল’ বোর্ডও একটু কেশে নিয়ে শেষ চেষ্টার পারানি হাতে জানিয়ে দিচ্ছে, মৌখিক তালাক চলছে, চলবে। গলা কিন্তু কাঁপছে। কারণ এদেশের বহু মুসলিম নারী-পুরুষের দাবি-
    এই মাটি জল আমার স্বদেশ
    আমার স্বজন এই আদালত
    ... (মল্লিকা সেনগুপ্ত) ...
    কৃতজ্ঞতাঃ শ্রী সহিদুল ইসলাম।....

    ReplyDelete
  4. https://m.facebook.com/WERHINDU/photos/a.1537570716517214.1073741827.1537000513240901/1646087438998874/?_e_pi_=7%2CPAGE_ID10%2C9969556166

    ReplyDelete