Wednesday, 29 July 2015

পাক সার জমিন সাদ বাদ" -- (পর্ব - ১৩)

এই শতাব্দীর এক অকুতোভয় অনন্যসাধারন বামপন্থী কথা সাহিত্যিক শ্রী 'হুমায়ূন আজাদ' ও বাংলাদেশের হিন্দু নিপীড়নের উপর তার অমর কালজয়ী সৃষ্টিঃ "পাক সার জমিন সাদ বাদ" -- (পর্ব - ১৩) ---------------------------------------------------------- একরাত, একদিন; ওটা আমাদের জন্য সামান্য সময় ছিল না, ছিল হাজার বছরের সমান, এতো দীর্ঘ সময় ধরে শান্তিতে থাকা আর শান্তিতে রাখা কতোটা কঠিন, ওই সময় আমরা ছাড়া আর কেউ বোঝেনি। শান্তি বড়ই ভারি ব্যাপার, যখন আমাদের ভিতরে বিজয়ের পবিত্র অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন শান্তি দোজগের শাস্তির মতন লাগছিল। পত্রিকাগুলো পর দিন আমাদের প্রশংসায় মেতে উঠেছিল। মেইন পার্টির সঙ্গে আমরা ল্যান্ডস্লাইড করলেও নিজেদের শান্ত রেখেছি, অর্থাৎ মেইন পার্টির খিলজিরা ঠান্ডা রয়েছে; এমনকি বিজয়উতসবও করি নি, গনতন্ত্র একেই বলে। আমাদের মত মহৎ আর কে? আমরা একরাত একদিন মহত্ত্ব অর্জন করি, কৃতিত্বের বরো ভাগটাই মেইন পার্টির খিলজিরা নেয়, আমাদের হিশাবের মধ্যে আনে না; কিন্তু আমরা যে মেইন পার্টির আসল ফোর্স তা তারা বোঝেনি। তনে খিলজিরা ও আমরা বুঝতে পারি কত দীর্ঘ হতে পারে একটি রাত ও একটি দিন, তা একশো বছরের সমান; তবে আমাদের সামনে তখন সহস্র ও একরাত, তার থেকেও বেশি। প্রশংসাধন্য হওয়ার পর কেউ আমাদের আর নিন্দা করতে পারে নি; নিন্দা করার সাহস পায়নি। মরা তখন শান্তিশৃঙ্খলার ফেরেশতা, আমাদের আগুনের ডানা থেকে ঝলকে ঝলকে শান্তি ঝরে পড়ছিলো। কিন্তু বিজয়ের পর একরাত ও একদিন নিষ্ক্রিয় থাকা, শান্তিতে থাকা, শান্তিতে রাখা, আমাদের জন্য হৃদয়বিদারক ছিলো। শাদি হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা ছহবত করতে পারছিলাম না, যদিও সব কিছু ছিল টানটান। টানটান জিনিশ নিয়ে একরাত একদিন কাটানোর কষ্ট আমরা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। তারপর দিন থেকে মেইন পার্টির নিষ্ঠাপরায়ন, প্রচন্ড, তীব্র,ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, দয়ালু, জনসেবক, রাজপথের যোদ্ধা নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমরা জিহাদিরা দেশজুড়ে শান্তির ঝড় বইয়ে দিয়েছিলাম। ওটার নাম দিয়েছিলাম আমরা ‘শান্তির ঠান্ডা আগুন’, সোভানাল্লা। দেশ এমন শান্তির ঠান্ডা অগ্নি আগে কখনও দেখেনি, সোভানাল্লা। আমরা, জিহাদিরা ও মেইন পার্টির ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজিরা, মিলেমিশে কাজ করেছি; তখন দেশ আমাদের পায়ের নীচে, আমাদের আগুনের নীচে, আমাদের পিস্তলের নীচে এবং সবচেয়ে যেটি শক্তিমান ও উদ্ধত পিস্তল- দেশ তখন আমাদের দীর্ঘ উদ্যত শিশ্নের ছায়ার নীচে, সোনার বাংলাকে আমরা তখন আসল সোনার বাংলা করে তোলার জন্য উত্তেজিত। আমাদের শিশ্ন বারবার দৃঢ় হচ্ছিলো, হুর ও উর্বশীদের জন্য ব্যাকুল হচ্ছিলো; কিন্তু আমরা গনতন্ত্র মেনে নিয়েছিলাম- একরাত ও একদিন। জিহাদি ও খিলজি, এবং জিহাদি ও খিলজিতে ভাগ হয়ে আমরা ছড়িয়ে পরি, সন্ধ্যার একটু পরেই। আমি মালাউন পছন্দ করি, মহান আল্লতালাই আমাদের এই অপূর্ব রুচিটি দিয়েছেন, আলহামিদুদিল্লা;ওদের ঘাম আমার পছন্দ, ওদের ঠোঁট আমার পছন্দ; আমি বেছে নিই মালাউন পাড়াগুলো এবং আমাকে দেওয়া হয় মালাউন পাড়াগুলো, তবে সবগুলো নয়। আমার প্রিয় দোস্ত, বিখ্যাত খিলজি মেইন পার্টির ছৈয়দ ছব্দর আলি বল্টু,- তার পছন্দ দুটিই, এক মালাউন আর আগের মেইন পার্টির দালালদের পাড়াগুলো; সে মনে করে সব কিছু তার তলোয়ার আর শিশ্নের নিচে। এটাকে সে বাস্তবায়িত করেছে, করে চলেছে, তবে তার কপালে কি আছে তা রাহমানির রহিমই জানেন। আমরা ‘শান্তির ঠান্ডা আগুন’ দিয়ে মালাউন ও মালাউনদের দালালদের শান্ত শীতল নীরব নিথর করতে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের জিহাদিদের আগুন লাগাতে হয় না, আমরা ঘরে ঘরে ঢুকি ওরা কাঁপতে থাকে; আমরা বেশি কিছু চাই না- একবারের জন্য খুনটুন করার দরকার ছিল না, দরকার ছিল চিরকালের জন্য খুন করা। ক্রমশ...

No comments:

Post a Comment