Saturday, 25 July 2015

দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ

দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ পরিচিত নাটক। স্বাদেশিকতা, নীল বিদ্রোহ ও সমসাময়িক বাংলার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে এই নাটকের যোগাযোগ অত্যন্ত গভীর। এই নাটকটি তিনি রচনা করেছিলেন নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ-কেনচিৎ-পথিক ছদ্মনামে। যদিও এই নাটকই তাঁকে খ্যাতি ও সম্মানের চূড়ান্ত শীর্ষে উন্নীত করে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, “ ‘নীলদর্পণ’ নাটক প্রকাশিত হলে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হলে একদিনেই এ নাটক বাঙালিমহলে যতটা প্রশংসিত হয়েছিল, শ্বেতাঙ্গমহলে ঠিক ততটাই ঘৃণিত হয়েছিল। এই নাটক অবলম্বন করে বাঙালির স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা, এই নাটক সম্বন্ধে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও রায়তদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়, এর মধ্যে দিয়েই শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের বর্বর চরিত্র উদ্ঘাটিত হয়। ” মনে করা হয়ে থাকে, নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তবে আধুনিক গবেষকগণ এই বিষয়ে একমত নন। এই অনুবাদ Nil Durpan, or The Indigo Planting Mirror নামে প্রকাশ করেছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। এই অনুবাদ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং জেমস লঙের জরিমানা ও কারাদণ্ড হয়। জরিমানার টাকা আদালতেই দিয়ে দেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়। নীলদর্পণ নাটকের মূল উপজীব্য বিষয় হল বাঙালি কৃষক ও ভদ্রলোক শ্রেণীর প্রতি নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী। কিভাবে সম্পন্ন কৃষক গোলকমাধবের পরিবার নীলকর অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেল এবং সাধুচরণের কন্যা ক্ষেত্রমণির মৃত্যু হল, তার এক মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই নাটকে। তোরাপ চরিত্রটি এই নাটকের অত্যন্ত শক্তিশালী এক চরিত্র; বাংলা সাহিত্যে এর তুলনা খুব কমই আছে। এই নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আঞ্চলিক ভাষার সাবলীল প্রয়োগ। কর্মসূত্রে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় যে দক্ষতা দীনবন্ধু আয়ত্ত করেছিলেন, তারই এক ঝলক দেখা মেলে এই নাটকের জীবন্ত চরিত্রচিত্রণে। নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রেরিত হয়। স্বদেশে ও বিদেশে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ফলে সরকার ইন্ডিগো কমিশন বা নীল কমিশন বসাতে বাধ্য হন। আইন করে নীলকরদের বর্বরতা বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীকালে এই নাটকের সঙ্গে স্টো-এর আঙ্কল টমস কেবিন গ্রন্থের তুলনা করেছিলেন। তা থেকেই বোঝা যায়, সেই সময়কার বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সমাজজীবনে এই নাটক কি গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজের তৃণমূল স্তরের মানুষজনের জীবনকথা এমনই স্বার্থক ও গভীরভাবে নীলদর্পণ নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে যে অনেকেই এই নাটককে বাংলার প্রথম গণনাটক হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আবার বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে এই নাটকই প্রথম জাতির জীবনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। লং, রেভারেন্ড জেমস (১৮১৪-১৮৮৭) চার্চ মিশনারি সোসাইটির একজন যাজক। তিনি প্রাচ্যবিদ ও সক্রিয় মানবতাবাদী হিসেবে বাংলা ও ইংল্যান্ডে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী লং প্রথম জীবনে কিছুকাল রাশিয়ায় বসবাস করেন। ঊনিশ শতকে ধর্মান্তরণের কাজে বাংলায় আগত মিশনারিদের মধ্যে জেমস লং ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি চার্চ মিশনারি সোসাইটির লন্ডনস্থ আইলিংটন কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডের গির্জার ‘ডিকন’ এবং পরের বছরই যাজক পদে অভিষিক্ত হন। লং ১৮৩৯ সালে যাজকরূপে কলকাতায় আসেন। কলকাতার দক্ষিণে ঠাকুরপুকুর গ্রাম ছিল তাঁর নির্ধারিত কর্মক্ষেত্র। সেখান থেকে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি তাঁর কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।

2 comments:

  1. জেমস লং বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসিসহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং অচিরেই একজন প্রাচ্যবিদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত (১৮৪৩) তাঁর Comparative Phiogy শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ ভারতীয় ভাষা অধ্যয়নে নিয়োজিত সমকালীন বিশ্বের অন্যান্য ভাষাবিদের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করে। বাংলার অধিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশার সময় লং স্থানীয় লোকদের মধ্যে প্রবাদ-প্রবচনেরব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করেন এবং উপলব্ধি করেন যে, তাদের ব্যবহূত প্রবাদ-প্রবচন গভীর অর্থবোধক এবং প্রকাশভঙ্গিতে খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি বাংলার সব অঞ্চল থেকে প্রবাদবাক্য সংগ্রহ করে টীকা-টিপ্পনীসহ সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর সংকলিত Bengali Proverbs গ্রন্থটি (১৮৫১) বিকাশমান বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
    রেভারেন্ড জেমস লং এর অবদান
    পরবর্তী দুই দশক তিনি বাংলা প্রবাদবাক্য ও বাংলা লোকসাহিত্য বিষয়ে আরও অধ্যয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বাংলার সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়নকালে লং A catalogue of Bengali Newspapers and Periodicals from 1818-1855 এবং Descriptive Catalogue of Vernacular Books and Pamphlets (১৮৬৫) প্রকাশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ধাতুমালা, দৃষ্টান্তরত্ন, জীব-রহস্য, প্রাচ্য প্রবচন, পুরাতন কলকাতা, Selections from Unpublished Records of Government, Report on the Native Press of Bengal, Early Bengali Literature and Newspapers.
    একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে রেভারেন্ড লং উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশ নীলকরদের কার্যকলাপ গ্রামীণ বাংলায় ধর্মান্তরণের অগ্রগতির পরিপন্থী। তিনি ইন্ডিগো কমিশনে এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, জনগণ প্রায়শ তাঁর প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে, যেমন, ‘তুমি তোমার দেশবাসী নীলকরদের অত্যাচার হ্রাস করতে বলোনা কেন, যাও তাদের কাছেই প্রথম ধর্মপ্রচার কর’।
    গ্রামীণ জনগণের সাথে জেমস লং-এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে তাঁর এ বিশ্বাস জন্মে যে, ব্রিটিশ বণিক গোষ্ঠী এবং এমনকি সরকারও জনসাধারণ, বিশেষ করে নীলচাষিদের প্রতি অন্যায় ও নিপীড়নমূলক আচরণ করে থাকে। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রথমে বেনামে প্রকাশিত নীলদর্পন নামক নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীলকরদের অত্যাচারের যে চিত্র তুলে ধরেন, তার সাথে তিনি সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। লং স্বরচিত ভূমিকাসহ নাটকটি ইংরেজিতে

    ReplyDelete
  2. ‘Five Hundred Questions on the Subjects Requiring Investigation in the Social Condition of the Natives of Bengal’ শিরোনামে
    এক সুদীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাঁর এই প্রতিবেদন কলকাতার বেথুন সোসাইটি (প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৫১), গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি (১৮৬৬) সহ ভারত ও ব্রিটেনের বহু বিদ্বৎ সংস্থার কার্যবিবরণীতে প্রকাশিত হয়। এছাড়া উপনিবেশিক সরকারের অপশাসন সম্পর্কে ব্রিটেন ও ভারতে তিনি জনসাধারণের কল্পনাকে কতটা অধিকার করেছিলেন তার প্রকাশ ঘটেছে একটি পৃথক সংস্করণ হিসেবে তাঁর এই প্রতিবেদনটির বহু পুনর্মুদ্রণের মাধ্যমে।
    ১৮৭২ সালে জেমস লং চিরতরে কলকাতা ত্যাগ করেন এবং জীবনের অবশিষ্ট কাল লন্ডনে অতিবাহিত করেন। ১৮৮৭ সালের ২৩ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর সকল জীবনালেখ্যে তাঁকে একজন বিখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ ও মানবতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি Long Lectureship on Oriental Religion নামে এক বৃত্তি প্রবর্তন করে যান, যা এখনও চালু রয়েছে।
    সূত্র: ইন্টারনেট
    প্রচ্ছদ, পরিকল্পনা, সংযোজনা, সম্পদনা - প্রতিবেদক।

    ReplyDelete